মোঃ আবদুর রহমান
বিশ্ব সভ্যতার এখন সবচেয়ে আলোচিত আশঙ্কা করোনা পরবর্তী অনিবার্য খাদ্য সংকট। এরই মধ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, বিশ্বজুড়ে খাদ্যের সংকট তৈরি হতে পারে। মহামারি করোনাভাইরাসের থেকেও অধিক ধ্বংসাত্মক এ সংকটে বিশ্বের প্রায় ৩ কোটি লোকের প্রাণহানি হতে পারে ধারণা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশও ওই আশঙ্কার আওতাভুক্ত। তবে আশার কথা, আমাদের দেশের উর্বর মাটি ও পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার তথা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারলে আসন্ন খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ সীমিত। কিন্তু জনসংখ্যা ক্রমে বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। কিন্তু জমি বাড়ছে না; বরং কমছে। সে সাথে উর্বরা জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন মাছের ঘের। তাই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার করোনা পরবর্তী খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এসব মৎস্য ঘেরের পাড়ে বা বেড়িতে শসা ও অন্যান্য উপযোগী সবজি চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মৎস্য ঘেরের পাড়ের জমিতে এ বছর ব্যাপক শসার চাষ হচ্ছে। গ্রামের রাস্তার পাশে বিস্তীর্ণ বিলজুড়ে শুধুই সবুজে ঘেরা শসাক্ষেত ঘেরের পাড়ে সারি সারি মাচায় ঝুলছে শসা আর শসা। আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় শসার বাম্পার ফলন হচ্ছে এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ঝিলিক। ক্ষেত থেকে শসা তুলে এনে স্থানীয় আড়তে ব্যবসায়ীদের কাছে ন্যায্যমূল্যে শসা বিক্রি করতে পেরে কৃষকরা অনেক খুশি।
শসা একটি লাভজনক ও অর্থকরী সবজি। বর্তমানে আমাদের দেশে হাইব্রিড জাতের অনেক শসা চাষ হয়ে থাকে। এ জাতের শসার ফলন অনেক বেশি। এটি স্বল্প সময়ের সবজি। জাতভেদে বীজ বপণের ৩৫-৪০ দিন পর থেকেই ফল তোলা যায়। ধানের তুলনায় শসা চাষে ২/৩ গুণ লাভ হয়। অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে শসা চাষ এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
মৎস্য ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে মাছের পাশাপাশি জমি থেকে একটা বাড়তি ফসল পাওয়া যায়। এতে পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত শসা বিক্রি করে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হওয়া যায়। ঘেরের পাড়ের মাটি বেশ উর্বর। এতে চাষকৃত শসা গাছ চারদিক থেকেই সূর্যের আলো পায়। এতে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়। সাধারণত মৎস্য ঘেরের পাড় উঁচু হয়। তাই বৃষ্টির পানি দ্রæত সরে যায়। এ কারণে বর্ষাকালে ঘেরের পাড়ে খুব সহজে শসা চাষ করা যায়। ঘেরের ভেতর পানির ওপর মাচা তৈরি করে সেখানে শসা চাষ করায় বাড়তি জায়গা লাগে না। ঘেরের পাশে পানি থাকায় শসাগাছে পানি সেচ দিতে সুবিধা হয়। তা ছাড়া ঘেরের পাড়ের শসাগাছের পরিচর্যা করতেও সুবিধা হয়।
তবে মৎস্য ঘেরের পাড়ে শসা চাষে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পোকার মধ্যে থ্রিপস, সাদা মাছি পোকা ও মাকড় এবং রোগের মধ্যে ডাউনি মিলডিউ শসার বেশি ক্ষতি করে। এ ছাড়া শসাগাছের পাতা ও ফলে অনুখাদ্য বোরন ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব দেখা যায়। অধিকন্তু, নিম্নমানের বীজ ব্যবহারের কারণে অনেক সময় শসার আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। তদুপরি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা ও অতি বৃষ্টিপাতের কারণে শসা চাষ ব্যাহত হয়। থ্রিপস ও সাদা মাছিপোকা দমনের জন্য ডেনিম ফিট-৫০ ডবিøউজি (১০ লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম) বা টিডো-২০ এসএল (১০ লিটার পানিতে ২.৫ মিলি.) অথবা মোভেন্টো-১৫০ (১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি.) মাকড়ের জন্য ভারটিমেক-০১৮ ইসি (১০ লিটার পানিতে ১৫ মিলি.) বা অ্যামবুশ-১.৮ইসি (১০ লিটার পানিতে ১২ মিলি.) অথবা মিটিসল- ৫ইসি. (১০ লিটার পানিতে ২০ মিলি) আর ডাউনি মিলডিউ রোগ প্রতিকারের জন্য রিডোমিল গোল্ড এমজেড-৬৮ ডবিøউজি (১০ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম) বা এনট্রাকল-৭০ ডবিøউপি (১০ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম) ব্যবহার করা হয়। বোরন ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি পূরণের জন্য যথাক্রমে সলুবর বোরন (১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম) ও ম্যাগমা অথবা ম্যাগাভিট (হেক্টরপ্রতি ১৫ কেজি) ব্যবহার করা হয়। খরা মোকাবিলায় ঘেরের পাশ থেকে শসাগাছে পানি সেচ দেয়া হয়।
বসতবাড়ি কিংবা মাঠের চেয়ে ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। অন্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে শসা চাষে ঝুঁকে পড়েছেন কৃষকেরা। ঘেরে শুধুমাত্র মাছ ও ধান চাষ করে একসময় যাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটত, ঘেরের পাড়ে শসা ও অন্যান্য শাকসবজি চাষে এখন তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। মূলত ঘেরের পাড়ে শসা চাষ পাল্টে দিচ্ছে রূপসা উপজেলার অন্তত আঠাশ গ্রামের চিত্র। রূপসা উপজেলার আনন্দনগর গ্রামের শসা চাষিরা জানান, এ বছর মৎস্য ঘেরের পাড়ে এক বিঘা জমিতে গ্রীন লাইন নামক হাইব্রিড জাতের শসা চাষ করেছে। এতে বীজ, সার, মাচা তৈরি, শ্রমিক ও কীটনাশক বাবদ প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এরই মধ্যে ১শ’ মণ শসা (প্রতি মণ ৪ শ’ টাকা দরে) স্থানীয় আড়তে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। আরো প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার শসা বিক্রি করতে পারবে বলে আশা ব্যক্ত করছে। আবহাওয়া অনুক‚লে থাকালে শসার ফলন ভালো হয় এবং দামও ভালো পাওয়া যায়। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও শসা চাষে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী কৃষকের পাশে থেকে শসা চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ।
ঘেরের পাড়ে উৎপাদিত শসা কেনাবেচার জন্য গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে শসার মওসুমি আড়ত। স্থানীয়ভাবে এ আড়তকে ‘গালা’ বলা হয়। তাই শসা বিক্রি করতে সাধারণত পরিবহন খরচ লাগে না। কৃষকেরা খেত থেকে শসা তুলে এনে আড়তে বিক্রি করেন। শসা চাষে মহিলা ও বেকার যুবকসহ স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে ট্রাকযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে এখানকার শসা। এতে করোনা মহামারির কারণে কৃষি ক্ষেত্রে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা। ইমেইল : rahman.rupsha@gmail.com, মোবাইল ঃ ০১৯২৩৫৮৭২৫৬